
শুদ্ধ ফজরের শুদ্ধস্বর থেকে শুরু করে উত্তপ্ত দুপুর; তারপর বিষণ্ন সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘুমচোখো রাত– সময়ের সবটুকু জুড়ে পৃথিবী শব্দ করে। শব্দ করি আমরাও। আমাদের আলোড়ন কানে কানে, ফিসফিস, জোরগলায় কিংবা হইহুল্লোড়– সবরকমেই হয়। পৃথিবীর ঘূর্ণিমালায় আমাদের এসব আলোড়ন কিংবা ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে ভাষা বলে। ভাষা বান্দার ওপর রব্বুল আলামিনের বিশেষ নেয়ামত। এ নেয়ামতের পরিতৃপ্তি নিয়েই বেঁচে আছে সৃষ্টিজগত।
মহান আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। পৃথিবীর একমাত্র নিপুণ কারিগর তিনি। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই অনবদ্য। রূপে-গুণে ভিন্ন ও বৈচিত্র্যময়। আর তাই রূপবৈচিত্রের এই শ্রেষ্ঠত্বে মহান আল্লাহ পৃথিবীজুড়ে দিয়েছেন ভাষা ভিন্নতাও। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন,
তাঁর নিদর্শনসমূহের মধ্যে হলো আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। (সুরা আর রুম ২২)
প্রতিটি সৃষ্টিই তার স্বীয় ভাব-ভঙ্গিমায় মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মাতৃভাষায় মনের উচ্ছ্বাস সহজে প্রকাশ করে। স্বভাষাতেই কঠিন জিনিসকে সহজে লালন করে। এ কারণেই যুগে যুগে উম্মতের হেদায়াত বার্তা নিয়ে পৃথিবীতে যত নবি-রসুল এসেছেন, প্রত্যেককেই স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন আল্লাহ। মাতৃভাষার মাহাত্ম্যের স্বীকৃতি দিয়ে তিনি জানিয়েছেন,
আমি রসুলগণকে স্বজাতির ভাষা দিয়েই প্রেরণ করেছি, যেন তারা আপন জাতিকে সুষ্ঠুভাবে বোঝাতে পারেন। (সুরা ইবরাহিম ৪)।
কাজেই ইসলামে দাওয়াতের ক্ষেত্রে মাতৃভাষার সঙ্গে বিশুদ্ধভাষী হওয়াও জরুরি। হজরত মুসা (আ.)-এর মুখে জড়তা ছিল। হজরত হারুন (আ.) তার চেয়ে অধিক বিশুদ্ধভাষী ছিলেন। তাই হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন,
আর আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে অধিক বিশুদ্ধভাষী, সুতরাং তাকে আমার সহায়ক হিসেবে আমার সঙ্গে নবুওয়াত দান করুন। সে আমাকে সত্য প্রতিপন্ন করবে। আমি আশঙ্কা করি তারা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করবে (সুরা ক্বাসাস : ৩৪)।
প্রিয়নবী (সা.)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ মুজেজা পবিত্র কোরআন। এই গ্রন্থ আরবের ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব ও অলংকার বিবেচনায় কোরআনুল কারিম সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। পবিত্র এই গ্রন্থের অসাধারণ ভাষাশৈলীতে মুগ্ধ পৃথিবীর কবি-সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানীরা। রহমাতুললিল আলামিন (সা.)-এর মুখের ভাষাও ছিল বিশুদ্ধ-মানোত্তীর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে তিনি বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। মদিনা রাষ্ট্রের সব কাজ বিশুদ্ধ আরবিতে সম্পাদনা করতেন। অশুদ্ধ ভাষা সবসময় এড়িয়ে চলতেন। তার সাহাবায়ে কেরামও দাওয়াত এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশে পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছেন, সর্বপ্রথম সেই অঞ্চলের ভাষা আয়ত্ত করেছেন। তারপর সে ভাষাতেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন।
এদিকে কোরআন-হাদিসের একাধিক স্থানে শব্দচয়নের ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। যেমন অর্থবিকৃতির আশঙ্কা থাকায় মুমিনদের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ বলেন,
হে মুমিনরা, তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না, ‘উনজুরনা’ বলো এবং শুনতে থাকো। (সুরা বাকারা : ১০৪)।
একবার জনৈক সাহাবি রসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আ-আলিজু?’ প্রবেশ করা অর্থে এই শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় আছে, কিন্তু অনুমতি কিংবা প্রার্থনার ক্ষেত্রে তা প্রমিত শব্দ নয়। প্রমিত শব্দ হলো ‘আ-আদখুলু?’। নবী (সা.) তাকে বললেন, তুমি ‘আ-আদখুলু’ বলো।
এছাড়া, বিশুদ্ধ হাদিসগ্রন্থ সহিহ মুসলিমে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই আছে ‘কিতাবুল আলফাজ’ তথা ‘শব্দচয়ন অধ্যায়’। সেখানে বিভিন্ন হাদিসে রাসুল সা.-এর শব্দ প্রয়োগের নির্দেশনা বিবৃত হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা এশার নামাজকে ‘আতামা’ বলো না, বরং ’এশা’ বলো।’’ অন্য হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘‘তোমরা ‘আঙুরকে’ ‘করম’ বলো না, ‘ইনাব’ বলো।’’ এসব দিক বিবেচনায় ফুক্বাহায়ে কেরাম বলেন, মাতৃভাষায় বিশুদ্ধ কথা বলা সুন্নত।